সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের ঐতিহাসিক তাৎপর্য

 সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের ঐতিহাসিক তাৎপর্য কী ছিল ? এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হল কেন ?


        মুঘল আমলের ইতিহাস গ্রন্থ 'দবিস্তান' বা গুলাম হুসেন রচিত 'সিয়ার-উল-মুতাখ্খিরিন' থেকে জানা যায়— অষ্টাদশ বা তার আগে উত্তর ভারতের দশনামী সন্ন্যাসী, শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত নাগা, মারাঠা সম্প্রদায়ভুক্ত গোঁসাইরা বা বেশরা সুফি সম্প্রদায়ভুক্ত মাদারি ফকিররা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াত এবং ফেরার পথে স্থানীয় জমিদার ও ভূস্বামীদের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করত।

        এই সন্ন্যাসী ও ফকিরদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলা ও বিহারে স্থায়ীভাবে বসবাস করে এবং কৃষিকাজ ও সিল্ক, মশলা প্রভৃতির ব্যবসাকে তারা পেশা হিসেবে বেছে নেয়। ওয়ারেন হেস্টিংস এর সময়ে নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় এরা ভূমি থেকে উচ্ছেদ সহ সরকারের শাসন ও শোষণের শিকারে পরিণত হয় এবং প্রতিবাদে তারা বিদ্রোহে নামে।

      ১.  কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে ১৭৬৩ খ্রি. সংঘটিত প্রথম কৃষক বিদ্রোহ ঐতিহাসিকভাবে খুব তাৎপর্যপূর্ণ। সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ছিল ঔপনিবেশিক আমলে সংগঠিত প্রথম কৃষক বিদ্রোহ, প্রায় ৩৭ বছর (১৭৬৩ খ্রি.- ১৮০০ খ্রিঃ) ধরে চলেছিল এই বিদ্রোহ, যার নজির ঔপনিবেশিক আমলে কোন কৃষক বিদ্রোহে লক্ষ্য করা যায়নি।

   ২. হিন্দু-মুসলিম সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে শামিল হয়েছিল এই বিদ্রোহে, তাদের লক্ষ্য ছিল কোম্পানি শাসনের হাত থেকে মুক্তি, যেজন্য সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহকে অনেকে স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম বলেছেন।

     ৩. অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের আন্দোলন এবং বিদ্রোহগুলির মধ্যে সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ছিল প্রথম সশস্ত্র অভ্যুত্থান, প্রথম গেরিলা পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছিল এই বিদ্রোহে। পরবর্তীকালে সংঘটিত সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রদূত বলা যায় এই বিদ্রোহকে ।

     ৪. স্থানীয় গণ্ডি অতিক্রম করে সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ বৃহৎ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল, রামপুর থেকে বোলপুর এবং ঢাকা থেকে রংপুর পর্যন্ত এই বিদ্রোহ প্রসারিত হয়েছিল, ফলে সেই অর্থে সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহকে 'গণ বিদ্রোহ' বলা যায়।


      সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের লক্ষ্য ও আদর্শ প্রভাবিত করেছিল সাহিত্যিকদের, যার প্রভাব পরবর্তীকালে 'আনন্দমঠ' ও ‘দেবী চৌধুরানী' উপন্যাসে লক্ষ্য করা যায়। আনন্দমঠ পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে মূল প্রেরণা হয়ে উঠেছিল। কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা এই বিদ্রোহ বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয়—

     ১. ইংরেজ সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের নেতাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাব, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব বিদ্রোহকে ব্যর্থ করেছিল।

       ২. ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের অভাব এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা বিদ্রোহীদের দুর্বল করেছিল।

      ৩. বিদ্রোহের শেষদিকে নেতৃত্বের প্রশ্নে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ও ঐক্যহীনতা বিদ্রোহের লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url