নীলদর্পণ নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায়?
নীলদর্পণ নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায়?
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দীনবন্ধু মিত্রের নাটক 'নীলদর্পণ'-এ সে সময়ের নীলচাষ এবং নীলকরদের অত্যাচারে বাংলার সমাজ জীবনে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার মর্মান্তিক ছবি ফুটে উঠেছে।
অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পে নীলের চাহিদা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেলে মুনাফালোভী ইংরেজরা দাদনের জালে আবদ্ধ করে ছলে, বলে, কৌশলে দিল্লী থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাষীদের নীলচাষে বাধ্য করে, অন্যথায় চলে অকথ্য অত্যাচার, গৃহে আগুন, লুঠপাট, শারীরিক নির্যাতন, চাবুক-শ্যামাচাদের ব্যবহার, স্ত্রী-কন্যার অপহরণ-লাঞ্ছনা, পুলিশী নির্যাতন, খাদ্যাভাব— যার প্রতিবাদে ১৮৫৯-৬০ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় নীলবিদ্রোহ।
নীলবিদ্রোহ ছিল কৃষকদের মানসিক দৃঢ়তার দৃষ্টান্ত, সম্পূর্ণ ধর্ম নিরপেক্ষ ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম যা এ নাটকে সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে। অসহায়, অত্যাচারিত নীলচাষীদের দুঃখদুর্দশা, নীলকরদের অত্যাচার,জমিদারদের এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সামাজিক মানসিকতা, পারস্পরিক কর্তব্যবোধ, পিতৃভক্তি, অপত্যস্নেহ, সাম্প্রদায়িক ও সামাজিক মেলবন্ধন সবই প্রতিফলিত হয়েছে 'নীলদর্পণ' নাটকে।
চাষীদের প্রতিবাদ, প্রতিধ্বনিত হয়েছিল অক্ষয়কুমার দত্তের 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা', হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট' পত্রিকায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায়। এছাড়াও শিশিরকুমার ঘোষ, হরিনাথ মজুমদার, মথুরানাথ মৈত্র সোচ্চার হলেও সাহিত্যে প্রতিবাদের চরম প্রকাশ ঘটেছিল দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ’ নাটকে, যার ইংরেজী অনুবাদ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও প্রকাশ করেছিলেন রেভারেন্ড জেমস লঙ্। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় “নীলদর্পন’কে হ্যারিয়েট বিচার স্টো-র নাটক ‘আংকল টমস কেবিন'-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। নীলকরদের অকথ্য অত্যাচার ও নদীয়ার গুয়াতালির মিত্র পরিবারের বিপর্যয়ের কাহিনীকে ভিত্তি করে লেখা এই নাটকে তৎকালীন সমাজজীবনের অবস্থা, অনুভূতি, শাসন-শোষণ সংগ্রাম ও সম্প্রীতির চিত্র সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।