বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ
বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
বিকল্প শিক্ষানীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলায় উনিশ শতক থেকে ভাবনা চিন্তা শুরু হয়। গণমুখী এই শিক্ষাব্যবস্থার ঝোঁক ছিল বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার ওপর। কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে যোগেশচন্দ্র ঘোষ একটি অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলেন, লক্ষ্য বিদেশে গিয়ে কারিগরি বিষয়ে জ্ঞানার্জনকারী ছাত্রদের আর্থিক সাহায্য করা।
বাঙালির কারিগরি কল্পনার ইতিহাস ঘাঁটলে যে নামটি প্রথম উঠে আসে তিনি হলেন গোলকচন্দ্র, যিনি ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে বিলেত থেকে শ্রীরামপুর কাগজ কলে আনা বাষ্পীয় ইঞ্জিন সযত্নে পর্যবেক্ষণ করতে করতে কোন বিদেশী সাহায্য ছাড়া নিজে একটি বাষ্পীয় ইঞ্জিন নির্মাণ করে ফেলেন।
১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে সরকার এ দেশে টেলিগ্রাফ লাইন পাতার কাজ শুরু করলে এই বিভাগে প্রথম ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার শিবচন্দ্র নন্দী দুর্বার গতিতে পদ্মার বুকে সাবমেরিন কেবল পাতার কাজ নিতান্ত অল্পব্যয়ে শেষ করেন।
বাংলায় কারিগরি শিক্ষার প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে পি.এম. বাগচি অ্যান্ড কোম্পানির অবদান গুরুত্বপূর্ণ। এই কোম্পানি প্রাচ্যে প্রথম কালি, সুগন্ধি প্রসাধন, রবার স্ট্যাম্প, পঞ্জিকা তৈরী করে।
কারিগরি শিক্ষা ও শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুভূত হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার। কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে সরকার ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে 'কলকাতা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ' প্রতিষ্ঠা করে, পরে এর নাম হয় বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ১৮৮০ খ্রিঃ কলেজটি হাওড়ায় স্থানান্তরিত করা হয়।
বাংলায় স্বদেশী আন্দোলনকালে জাতীয় নেতৃবৃন্দ সরকারি শিক্ষার বিকল্প হিসেবে জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভব করেন, যার মাধ্যমে তাঁরা জাতীয়তাবাদী ও বাস্তবমুখী শিক্ষাদানের কথা বলেন।
এই ভাবনা থেকে ১৯০৫ খ্রিঃ ১৬ই নভেম্বর পার্কস্ট্রীটে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই আলোচনা সভার সিদ্ধান্ত মতো ১৯০৬ খ্রিঃ ১১ই মার্চ জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। যার অন্যতম একটি লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো। জাতীয় শিক্ষাপরিষদের অধীনে ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৫ই আগস্ট অরবিন্দ ঘোষকে অধ্যক্ষ করে বেঙ্গল ন্যাশানাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে অসংখ্য বিদ্যালয় তৈরী হয়।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে তারকনাথ পালিত, নীলরতন সরকার, রাসবিহারী ঘোষ কারিগরি ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক শিক্ষাদানের পক্ষে ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে ১৯০৬ খ্রিঃ তারকনাথ পালিত গঠন করেন ‘সোসাইটি ফর প্রমোশন অব টেকনিক্যাল এডুকেশন ইন বেঙ্গল'। ওই বছরই আবার কলকাতার আপার সার্কুলার রোডে 'বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট' নামে একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যা শিক্ষার উন্নতি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এর প্রসার ঘটাতে এই প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
আর্থিক ও অন্যান্য কারণে বেঙ্গল ন্যাশানাল কলেজ ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এর সঙ্গে মিশে যায়। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানে প্রথম কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর পাঠ দেওয়া শুরু করে। ১৯২৪ খ্রিঃ এটি যাদবপুরে স্থানান্তরিত হয়। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে এর নামকরণ হয় ‘কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি।' ১৯৫৫-তে এটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।