বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীসমাজ

 বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীসমাজ কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিল? তাদের আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা কী ? 

        সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে সারা বাংলা জুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে উঠলে নারীরা দলে দলে এতে শামিল হয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী বয়কট ও জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে তারা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় ।

        বঙ্গভঙ্গের দিন প্রভাতে (১৯০৫ খ্রিঃ ১৬ই অক্টোবর) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে হিন্দু মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হিসেবে যে রাখী বন্ধন উৎসব অনুষ্ঠিত হয় তাতে মেয়েরা প্রবল উৎসাহে অংশ নেয় এবং কলকাতা সহ গ্রামে-গঞ্জের মন্দিরে, স্নানের ঘাটে সর্বত্র এই উৎসব ছড়িয়ে দেয়। 

    রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর আহ্বানে যে ‘অরন্ধন উপবাস দিবস' পালিত হয় তাতেও মেয়েরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। 

     বঙ্গভঙ্গের দিন বিকালে দুই বাংলার ঐক্যের প্রতীক রূপে কলকাতার আপার সার্কুলার রোডে যে মিলন মন্দিরের ভিত্তি স্থাপিত হয় তাতেও মেয়েরা শামিল হয়।

     স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম ধারা বয়কটে নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয়। বিদেশী শাড়ি চুড়ি সহ রান্নাঘরে বিলাতি লবণ, মশলা ও বিদেশী ওষুধের ব্যবহার বন্ধ করে, বিদেশী শিক্ষালয় ত্যাগ করে, বিদেশী পণ্যাগারের সামনে পিকেটিং-এ অংশ নেয়।


       বিদেশী দ্রব্য বর্জনের পাশাপাশি নারীরা স্বদেশী দ্রব্য তৈরী ও ব্যবহারের আহবান জানায়। স্বদেশী দ্রব্যের ব্যবহার বাড়াতে স্বর্ণকুমারী দেবী ‘সখী সমিতি' ও সরলাদেবী চৌধুরানী ‘লক্ষ্মীভাণ্ডার' স্থাপন করেন। নারীদের দ্বারা সম্পাদিত বিভিন্ন পত্রিকা যেমন - সরলাদেবী চৌধুরানী সম্পাদিত 'ভারতী’ সরযুবালা সম্পাদিত’ ‘ভারত মহিলা” বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রচারে বিশেষ ভূমিকা নেয়। অবলা বসুর উদ্যোগে মেরী কার্পেন্টার হলে প্রায় এক হাজার মহিলা বঙ্গভঙ্গর বিরুদ্ধে স্বদেশী শপথ নেয়। 

      বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন - সরলাদেবী চৌধুরানী, কুমুদিনী বসু, সুবালা আচার্য, হেমাঙ্গিনী দাস, নির্মলা সরকার, লীলাবতী মিত্র প্রমুখরা। 

      কলকাতার বাইরে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন – মুর্শিদাবাদের গিরিজা সুন্দরী, বরিশালের সরোজিনী দেবী, বীরভূমের দু'কাড়িবালা দেবী, খুলনার লাবণ্যপ্রভা দত্ত, ঢাকার ব্রাহ্মময়ী সেন।


সীমাবদ্ধতা : 

      বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করলেও তাদের আন্দোলনের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল- – 

     ১. আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চবর্গের বাঙালী হিন্দু পরিবারভুক্ত। কৃষক পরিবারের বা মুসলিম পরিবারের তেমন কোন নারী প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেয়নি।

     ২. মুসলিম পরিবারের খয়রুন্নেসা অবশ্য ‘নবনুর' নামক পত্রিকায় ‘স্বদেশানুরাগ' নামক রচনা প্রকাশ করে স্বদেশী আন্দোলনের প্রসারে সচেষ্ট হন।

      ৩. আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীরা প্রায়ই সবাই ছিলেন শহুরে ও অভিজাত। গ্রামের সাধারণ মেয়েদের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনে ছিল না।

     ৪.  সর্বোপরি নারীরা স্বাধীনভাবে এই আন্দোলন পরিচালনা করতে পারেননি, তাদের আন্দোলনসূচী ছিল পূর্বনির্দিষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url