নীলবিদ্রোহে সংবাদপত্রের ভূমিকা
নীলবিদ্রোহে সংবাদপত্রের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর।
বাংলার নীলচাষিদের দুরবস্থা ও নীলকরদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও বুদ্ধিজীবীমহল সরব হয়ে উঠেছিল।
সমকালীন প্রকশিত বিভিন্ন পত্র পত্রিকার মধ্যে সর্বপ্রথম ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে 'সমাচার চন্দ্রিকা' ও 'সমাচার দর্পণে" নীলকরদের অত্যাচারের কথা প্রকাশিত হয়। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে অক্ষয়কুমার দত্ত ‘তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকায় নীলচাষ ও চাষিদের দুরবস্থা নিয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন বার করেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের 'সংবাদ প্রভাকর' ও নীলবিদ্রোহীদের সমর্থনে খবর প্রকাশ করেন। নীলকরদের অত্যাচারের বিবদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছিল 'হিন্দু প্যাটিয়ট' পত্রিকা। এই পত্রিকার বিভিন্ন সময়ের সম্পাদক গিরিশচন্দ্র ঘোষ, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মনমোহন ঘোষ প্রমুখরা নীলচাষিদের সম্পর্কে নানাভাবে সাহায্য ও নীলকরদের অত্যাচারের কথা সংবাদ পত্রে প্রকাশ করেন। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নিজে এবং সাংবাদিক নিয়োগ করে নীলচাষিদের দুর্দশার খবর সংগ্রহ করে এই পত্রিকার ‘নীল জেলা নামক এক পাতায় তা প্রবন্ধাকারে প্রকাশ করেন।
হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে হরিশচন্দ্র মুখার্জি লেখেন বাংলার নীলচাষ একটি সংগঠিত জুয়োচুরি ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা মাত্র নীলচাষে চাষির লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি। যে চাষি একবার নীলচাষ করেছে তার আর বেঁচে থাকতে মুক্তি নেই। বস্তুত হরিশচন্দ্রের উদ্যোগেই নীল বিদ্রোহের খবরাখবর বাংলার শিক্ষিত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
হিন্দু-প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সাংবাদিক পরবর্তীতে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা'র সম্পাদক - শিশিরকুমার ঘোষ, হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় নীলচাষিদের সমর্থনে একাধিক পত্র লেখেন। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাষিদের ওপর অত্যাচারের খবর সংগ্রহ করে বাংলার প্রথম 'ফিল্ড জার্নালিস্ট' নামে পরিচিত লাভ করেন।
নীলবিদ্রোহ নিয়ে বিভিন্ন লেখক ও কবি তাদের রচনার মাধ্যমে নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী সমকালে ও বিদ্রোহের পরবর্তীকালে জনসমক্ষে তুলে ধরেন। সরকারি কর্মচারি ও বিশিষ্ট লেখক দীনবন্ধু মিত্র কেনাচিৎ পথিকস্য (কোন এক পথিক) ছদ্মনামে লেখেন 'নীলদর্পণ' নাটক, যেটি নীলচাষিদের ওপর নীলকরদের অত্যাচারের জীবন্ত দলিল। পত্রপত্রিকা, বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন ও সহযোগিতা নীলবিদ্রোহকে ধর্মনিরপেক্ষ গণবিদ্রোহে পরিণত করেছিল।