সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
বাংলার নবজাগরণে অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রাজা রামমোহনের মৃত্যুর পর শুকিয়ে যাওয়ার সমাজ সংস্কার আন্দোলনের মরা খাতে তিনি নতুন প্রবাহধারা সৃষ্টি করেন। তার সততা এবং ন্যায়নীতির প্রতি নিষ্ঠা এবং আত্মমর্যতাবোধ বাঙালি জাতিকে এক নতুন মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত করে।
i. বাল্যবিবাহ রোধে ব্যবস্থা:
ঈশ্বরচন্দ্র বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকটি উপলব্ধি করেছিলেন। এজন্য তিনি ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সর্বশুভকরী পত্রিকায় বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লেখেন।
![]() |
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর |
ii. বহুবিবাহের প্রতিবাদ:
তিনি পুরুষের বহুবিবাহের তীব্র নিন্দা করেন। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় বহুবিবাহের সমালোচনা করা হয়। বিদ্যাসাগর বর্ধমানের মহারাজার সহায়তায় পঞ্চাশ হাজার স্বাক্ষর সহ বহুবিবাহের বিপক্ষে আইন রচনার জন্য সরকারের কাছে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে এক আবেদন পাঠান।
iii. বিধবা বিবাহ আইন:
বিধবাদের মুক্তির জন্য তিনি আমরণ সংগ্রাম চালিয়ে যান। বিভিন্ন শাস্ত্র বিশ্লেষণ করে তিনি প্রমাণ করেন যে হিন্দু ধর্মে বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত। তিনি পরাশর সংহিতার একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেন। রক্ষণশীল সমাজপতিরা তাকে নানাভাবে লাঞ্ছিত করে। কিন্তু জীবন বিপন্ন করে তিনি আন্দোলন চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়।
iv. বিধবা বিবাহের বাস্তব প্রয়োগ:
বিধবা বিবাহ আইন পাস করিয়ে তিনি শান্ত ছিলেন না। তার উদ্যোগে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর শ্রীশ চন্দ্র বিদ্যারত্নের সঙ্গে বিধবা কালিমতি দেবীর বিবাহ হয়। তার নিজ পুত্র নারায়ণ চন্দ্রের ভব সুন্দরী নামে এক বিধবার সঙ্গে তিনি বিবাহ দেন।
v. মদ্যপানের প্রতিবাদ:
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে প্যারীচরণ সরকার সুরাপান নিবারণী সমিতির স্থাপন করলে বিদ্যাসাগর এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং সুরাপানের বিরুদ্ধে প্রচার চালান।
vi. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি:
বিদ্যাসাগর বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সাহায্যে অথবা সংস্কারপন্থী শিক্ষিত মানুষের সাহায্যে বাল্যবিবাহ রোধ, বহুবিবাহ নিষিদ্ধ, বিধবা বিবাহ, নারী শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে প্রচার করতে থাকেন।
vii. নারী শিক্ষার প্রসার:
বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন নারী জাতি শিক্ষা ছাড়া সমাজ কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারবেনা। এই কারণে তিনি নিজ উদ্যোগে ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয়ের স্থাপন করেছিলেন। এছাড়া কলকাতার মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন গঠন করেছিলেন। যার বর্তমান নাম বিদ্যাসাগর কলেজ। কলকাতায় স্ত্রী শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে ড্রিঙ্কওয়াটার বিটনের সহায়তায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যার বর্তমান নাম বেথুন স্কুল।
একথা অস্বীকার করা যায় না যে, রামমোহনের পর বিদ্যাসাগরের মতো এত ব্যাপক ও গভীরভাবে সমাজ সংস্কারের আর কেউ চেষ্টা করেননি। এর ফলে সমাজে চেতনা সৃষ্টি হয় ও কুপ্রথাগুলি ধীরে ধীরে ক্ষয় পায়।