পরিবেশের ইতিহাস
মানুষ এবং তার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে গঠিত হয় পরিবেশ। মানুষ তার সৃষ্টিকাল থেকেই পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে রয়েছে। বিভিন্ন সময় মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে প্রাকৃতিক উপাদানকে ধ্বংস করেছে। অন্য কথায় বলা যায়, পরিবেশকে নষ্ট করেছে। পরিবেশের এই ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে তার প্রভাব মানব সমাজে কিভাবে পড়বে এই বিষয়ে আলোচনা করে পরিবেশের ইতিহাস।
পরিবেশের ইতিহাস বলতে কী বোঝো?
মানুষ এবং তার পার্শ্ববর্তী প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যে শাস্ত্রে আলোচনা করা হয় তাকে পরিবেশের ইতিহাস বলে। মানব সভ্যতার ওপর পরিবেশের প্রভাব এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে মানুষের প্রতিক্রিয়া এখন ইতিহাস চর্চার মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
পরিবেশের ইতিহাস চর্চার সূচনা:
পরিবেশের ইতিহাস চর্চা শুরু হয় ১৯৭০ এর দশকে। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'দ্য সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট এডুকেশন'। এর পর থেকেই ভারতবর্ষে পরিবেশের ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব লাভ করে।
পরিবেশের ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইতিহাসবিদ নানাভাবে আলোচনা এবং গবেষণা করেছেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রাচেল কার্সনের 'দি সি এরাউন্ড আস' উল্লেখযোগ্য। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত সাইলেন্ট স্প্রিং ইত্যাদি গ্রন্থ পরিবেশের ইতিহাস সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করেছেন।
পরিবেশের ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্য:
পরিবেশের ইতিহাস চর্চার মূল উদ্দেশ্যগুলি নিচে আলোচনা করা হলো,-
i. পরিবেশ অতীতকাল থেকে কিভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে তা আলোচনা করা। মূলত মানুষের বিভিন্ন কাজকর্ম পরিবেশকে কিভাবে পরিবর্তিত করছে পরিবেশের ইতিহাস তা তুলে ধরে।
ii. প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের জীবনযাত্রাকে কিভাবে প্রভাবিত করছে তা আলোচনা করা।
iii. পরিবেশ সম্পর্কে মানব সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
ভারতে পরিবেশের ইতিহাস:
বিখ্যাত ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তার অশান্ত অরণ্য জীবন গ্রন্থে উপজাতীয় কৃষক জীবনের এক বিশেষ দিকে আলোকিত করে। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহ ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে রাম্পা বিদ্রোহ ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মুন্ডা বিদ্রোহ এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ কিভাবে শান্ত অরণ্য জীবনকে বিদ্রোহী করে তোলে ঐতিহাসিক গুহ সেই দিকেই ইতিহাস পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
মানব সমাজের উপর পরিবেশের প্রভাব এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে মানুষের প্রতিক্রিয়া ইতিহাস চর্চার এখন আলোচ্য বিষয়। ভারতের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিবেশ আন্দোলন গড়ে উঠেছে। যেমন- চিপকো আন্দোলন, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন ইত্যাদি। ১৯৭০ এর দশকে এই বিশেষ ধারার সূত্রপাত হলেও বর্তমানে এই বিষয়টি আরো গতি লাভ করেছে।
পরিবেশের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত ঐতিহাসিক এবং তাদের গ্রন্থ:
পরিবেশের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক হলেন আলফ্রেড ক্রসবি, মাইকেল মান, রিচার্ড গ্রোভ প্রমুখ।
উল্লেখযোগ্য ভারতীয় ঐতিহাসিক হলেন ইরফান হাবিব, মাধব গ্যাডগিল, রামচন্দ্র গুহ, মহেশ রঙ্গরাজন, বসন্ত সবেরওয়াল প্রমুখ।
কয়েকজন ঐতিহাসিকের বিখ্যাত কিছু গবেষণা কার্য হল,-
র্যাচেল কারসন-এর 'দ্য সাইলেন্ট স্প্রিং' (১৯৬২ খ্রি.),
ইরফান হাবির-এর 'পিপল্স হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া'
রামচন্দ্র গুহর ‘অশান্ত অরণ্যজীবন' এবং 'এনভায়রনমেন্টালিজম: আ গ্লোবাল হিস্ট্রি',
আলফ্রেড ক্রসবির 'ইকোলজিক্যাল ইম্পিরিয়ালিজম, রিচার্ড গ্রোভ-এর 'গ্রিন ইম্পিরিয়ালিজম,
শুভেন্দু গুপ্তর ‘প্রাচীন ভারতের পরিবেশ চিন্তা'
সুধাংশু পাত্রর 'বিশ্ব পরিবেশ ও মানুষ',
আবিরলাল মুখোপাধ্যায় রচিত 'শব্দের আশীর্বাদ, শব্দের অভিশাপ',
শমিত কর রচিত 'বিপন্ন পরিবেশ: বিপন্ন মানুষ' প্রভৃতি।
পরিবেশের ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব
পরিবেশের ইতিহাস চর্চার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে আলোচনা করা হলো।-
i. সচেতনতা বৃদ্ধি:
পরিবেশের ইতিহাস মানুষকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। অন্যান্য জীব, যেমন- গাছপালা, কীটপতঙ্গ, পশুপাখির মত মানুষও পরিবেশের একটি অঙ্গ। প্রত্যেকটি জীবের পরিবেশে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। পরিবেশের ইতিহাস এই সকল জীবকে তাদের অধিকারের কথা বলে। ফলে মানুষ পরিবেশ সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন হয়।
ii. মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা লাভ:
পরিবেশের সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্বন্ধ রয়েছে। পরিবেশের ইতিহাস মানুষের জীবনযাত্রা সংস্কৃতি ধর্মাচরণ কিভাবে পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় সে সম্পর্কে ধারণা দেয়। রামচন্দ্র গুহ তার 'অশান্ত অরণ্য জীবন' গ্রন্থে দেখিয়েছেন ইংরেজরা ভারতের অরণ্যের উপর অধিকার অর্পণ করলে কিভাবে তা আদিবাসী ও কৃষক সমাজকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল।
iii. মানুষ ও পরিবেশের কার্যকারণ সম্বন্ধ অনুধাবন:
অবৈজ্ঞানিক প্রথায় শিল্প, নগরায়ন, বৃক্ষচ্ছেদন, বননিধন করলে তা প্রকৃতির ভারসাম্য কিভাবে নষ্ট করে পরিবেশের ইতিহাস সে বিষয়ে আলোকপাত করে। মানুষের অবিবেচনা মূলক কাজকর্ম পরিবেশের কার্যকরণ সম্বন্ধে কিভাবে প্রভাব বিস্তার করে সে বিষয়ে ধারণা লাভ করা যায়।
iv. ঐতিহাসিক ঘটনা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ:
বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা পরিবেশের উপর কি প্রভাব ফেলেছিল সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। ইংরেজরা ভারতে শাসনকালে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্ম যেমন- রেলপথের বিস্তার, কৃষি ক্ষেত্র নির্মাণ প্রভৃতি কিভাবে পরিবেশকে পরিবর্তন করেছিল এবং তার প্রভাব মানব সমাজে কিভাবে পড়েছিল সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
সুতরাং, বলা যায় পরিবেশ যেমন আমাদের জীবন বাঁচায় তেমন পরিবেশের ইতিহাস আমাদের নানাভাবে সচেতন করে তোলে।