মরুকরণ টীকা

 যে সকল অঞ্চলের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 25 সেন্টিমিটার এর কম তাকে মরু অঞ্চল বলে। যান্ত্রিক আবহবিকার বেশি হওয়ার ফলে শিলাস্তর আলগা থাকে এবং বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে এই আলগা পদার্থগুলি স্থানান্তরিত হয়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে ঢেকে ফেলে।



মরুকরণ কাকে বলে? অথবা, মরুভূমির সম্প্রসারণ কাকে বলে? অথবা, মরুকরণ কি ?



ধারাবাহিকভাবে মরুভূমির ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি পাওয়াকে এক কথায় মরুকরণ বা মরুভূমির সম্প্রসারণ বলা হয়।

UNESCO-FAO এর সংজ্ঞা অনুযায়ী,  ভূমির জৈবিক ক্ষমতার হ্রাস অথবা ধ্বংসের ফলে মরুভূমি সদৃশ যে অবস্থা বা পরিবেশ সৃষ্টি হয় তাকে বলে মরুকরণ।


মরুকরণের কারণ কি ? বা মরুকরণ কিভাবে ঘটে

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন সমগ্র পৃথিবীর 35% জমি মরুকরণের শিকার হয়েছে। প্রতিবছর প্রায় 60 লক্ষ হেক্টর জমি মরুভূমির অধীনে চলে যাচ্ছে। যার ফলে প্রায় 85 কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিচে মরুকরণের কারণগুলি আলোচনা করা হলো,-

১. জলবায়ুর পরিবর্তন: সমগ্র পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন বা বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আবহাওয়া শুষ্ক হচ্ছে। এই কারণে যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রভাবে শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আলগা হয়ে পড়েছে, যা অতি সহজেই বায়ু দ্বারা বাহিত হতে পারে।


২. খরা: মরুপ্রান্ত বা মরুপ্রায় অঞ্চলে দীর্ঘদিন করার আবির্ভাব হলে মাটির শুষ্ক হচ্ছে এবং আলগা হয়ে পড়ছে। উদ্ভিদ প্রাণীকুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হয়ে মরুকরণের সূচনা ঘটছে।


৩. বায়ুর ক্ষয় কার্য: মরু অঞ্চলের বায়ুর ক্ষয়কার্য অধিক হলে সূক্ষ্ম বালি বায়ুর দ্বারা বাহিত হয়ে মরুভূমির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সঞ্চয় হলে, পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মরুভূমির অন্তর্গত হয়।


৪. পশুচারণ: মরুপ্রায় অঞ্চলে অত্যধিক পশুচরণে মাটি আলগা হয়ে অঞ্চলটি মরুভূমিতে পরিণত হয়।


৫. অবৈজ্ঞানিক কৃষিকাজ: শুষ্ক অঞ্চলে যে সকল ফসল ভালো জন্মায় তার পরিবর্তে অন্যান্য ফসল চাষ করলে অতিরিক্ত জল সেচ করতে হয়। মৃত্তিকার ভৌমজল তুলে নেওয়ার ফলে ওই অঞ্চলের মাটি লবণাক্ত এবং অনুর্বর হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়।


৬. বৃক্ষছেদন: গাছপালা কেটে ফেলা মরুকরণের অন্যতম কারণ। মিশরে ফ্যারাওদের নির্বিচারে গাছ কাটার কারণে মরুভূমি প্রাচীনকাল থেকেই সম্প্রসারিত হচ্ছে।


৭. পর্বতের অবস্থান: জলীয়বাষ্পপূর্ণ বাতাস প্রবাহিত হওয়ার সময় পর্বতের প্রতিবাত ঢালে বাধা পেয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই বাতাস পর্বতের অনুবাত ঢালে বৃষ্টিপাত ঘটায় না। দীর্ঘদিন এইভাবে চলতে থাকলে পর্বতের অনুবাত ঢালে বৃষ্টিপাতের অভাবে মরুভূমির সৃষ্টি হয়।


মরুকরণের প্রভাব

১. জীববৈচিত্র্য ধ্বংস: মরুকরণের ফলে স্থানীয় উদ্ভিদ এবং প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা হ্রাস পায় এবং জীবের উৎপাদন ক্ষমতাও কমে।


২. উর্বরতা হ্রাস: মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে উর্বরতা হ্রাস পায়।


৩. ভৌমজলের ঘাটতি: মরুভূমির পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মরুকরণের অধীন হলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার জন্য ভৌমজলের পরিমাণ হ্রাস পায়।


৪. বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস: মরুকরণের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পায়।


৫. কৃষিজমি ধ্বংস: মরুকরণের প্রভাবে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি ধ্বংস হয়। সিন্ধু সভ্যতা মরুকরণের প্রভাবে তার ঐতিহ্য হারিয়েছে বলে মনে করা হয়।


৬. অর্থনৈতিক অবনতি: যে অঞ্চল মরুকরণের অধীনে এসেছে সেখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।


কিভাবে মরুকরণ প্রতিরোধ করা যায় ? অথবা, মরুভূমির সম্প্রসারণ রোধের উপায়

মরুভূমির সম্প্রসারণ সরাসরি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে মরুকরণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হতে পারে। যেমন,-

১. পশুচারণ রোধ: মরুভূমির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যথেচ্ছ পশুচারণ বন্ধ করতে হবে।


২. উপযুক্ত ফসল চাষ: মরুভূমির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সেই অঞ্চলের সঙ্গে মানানসই বা খরা সহ্যকারী ফসলের চাষ করতে হবে।


৩. বায়ুর ক্ষয় প্রতিরোধ: বালির ওপরে একপ্রকার তৈলাক্ত পদার্থ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যা বালের উপরিভাগে প্লাস্টিকের আস্তরণের মতো প্রলেপ তৈরি করছে। ফলে বায়ু প্রবাহের দ্বারা বালুকণা অপসারিত হচ্ছে না।


৪. অগভীর কর্ষণ: মরু অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কৃষিকাজ করার জন্য অগভীরভাবে ভূমি কর্ষণ করতে হবে।


৫. বৃক্ষরোপণ: মরুপায় অঞ্চলগুলিতে খরা প্রতিরোধকারী বৃক্ষ রোপন করতে হবে এর ফলে মাটির আর্দ্রতা বজায় থাকবে এবং বায়ুর দ্বারা ক্ষয় কম হবে।


৬. সবুজ প্রাচীর নির্মাণ: মরুভূমির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে সবুজ অরণ্য বা গ্রেট গ্রীন ওয়াল সৃষ্টি করতে হবে। সাহারা মরুভূমির ক্ষয় প্রতিরোধ করার জন্য গ্রেট গ্রীন ওয়াল বা বৃহৎ সবুজের প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে।


৭. মৃত্তিকার আর্দ্রতা বজায় রাখা: জাতীয় নদী অববাহিকা কর্মসূচির মাধ্যমে মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url