বায়ুমণ্ডলের স্তর বিন্যাস ( Layering of Atmosphere )

  বায়ুমণ্ডলের স্তর বিন্যাস

বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস দুই ভাবে করা যায়। যথা- 

A. রাসায়নিক গঠন অনুসারে বা উপাদানের ভিত্তিতে স্তরবিন্যাসঃ 

              রাসায়নিক গঠন অনুসারে বা উপাদানের ভিত্তিতে বায়ুমন্ডলে কে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- 

ক) হোমোস্ফিয়ার বা সমমন্ডলঃ 

             গ্রিক শব্দ Homo অর্থ "সম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ" এবং Sphere অর্থ "মন্ডল"। ভূপৃষ্ঠ থেকে 88 কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন উপাদানগুলি একই অনুপাতে থাকে বা নির্দিষ্ট অনুপাতে থাকে। এই কারণে এই স্তরকে হোমোস্ফিয়ার ( Homosphere) বা সমমন্ডল বলে।

      বৈশিষ্ট্য  

        i)এই স্তরের মধ্যে বিভিন্ন গ্যাস, জলীয় বাষ্প, ধূলিকণা পাওয়া যায়। 

       ii) বিভিন্ন উপাদানগুলি একই অনুপাতে থাকে।

      iii) বাতাসের মিশ্রণ এই স্তরে সবচেয়ে বেশি হয়।


খ) হেটেরোস্পিয়ার বা বিষমমন্ডল 

           "Hetero" অর্থ "বিষম" এবং "Sphere" শব্দের অর্থ "মন্ডল"। হোমোস্ফিয়ারের উপরিস্তর থেকে অর্থাৎ 88 কিলোমিটার থেকে 10000 কিলোমিটার পর্যন্ত অংশে উপস্থিত গ্যাসের অনুপাত সমান থাকে না। এক একটি স্তরে এক একটি গ্যাসের প্রাধান্য থাকে বলে, এই স্তরকে হেটেরোস্পিয়ার (Heterosphere) বা বিষমমন্ডল বলে। 

    এই স্থরটি চারটি উপস্তরের বিভক্ত ,-  

        i) আণবিক নাইট্রোজেন স্তর (88-200 কিমি) - এই স্তরটি আণবিক নাইট্রোজেন দ্বারা গঠিত।

       ii) পারমাণবিক অক্সিজেনের স্তর (200-1120 কিমি) - অক্সিজেন অনুর প্রাধান্য রয়েছে। 

      iii) হিলিয়াম স্তর (1120-3540 কিমি) - হিলিয়াম অনুর প্রাধান্য রয়েছে। 

      iv) হাইড্রোজেন স্তর (3540-10000) - হাইড্রোজেন পরমাণুর প্রাধান্য আছে। 


B. উষ্ণতার বা তাপমাত্রার তারতম্য অনুসারে বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস 

    উষ্ণতার তারতম্য বা পার্থক্য অনুসারে বায়ুমণ্ডলকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- 

 ক) ট্রপোস্ফিয়ার (Troposphere)

          Tropo শব্দের অর্থ Mixing বা Turbulence এবং Sphere শব্দের অর্থ মন্ডল। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রতি 1000 মিটার উচ্চতা বৃদ্ধিতে তাপমাত্রা 6.4° সেলসিয়াস হারে কমতে থাকে। নির্দিষ্ট উচ্চতায় উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে তাপমাত্রা না কমে স্থির হয়ে যায়। ভূপৃষ্ঠ থেকে এই স্তর পর্যন্ত অংশকে ট্রপোস্ফিয়ার বলে। এই স্থরের উচ্চতা নিরক্ষীয় অঞ্চলে 18 কিলোমিটার, ক্রান্তীয় অঞ্চলে 12 থেকে 14 কিলোমিটার এবং মেরু অঞ্চলে 8 থেকে 9 কিলোমিটার।

   বৈশিষ্ট্য  

     i) প্রতি 1 কিমি বা 1000 মিটার উচ্চতা বৃদ্ধিতে তাপমাত্রা 6.4° সে হারে কমতে থাকে। একে উষ্ণতা হ্রাসের স্বাভাবিক হার ( Normal Lapse Rate) বলে।

    ii) ট্রপোস্ফিয়ারের সর্বোচ্চ সীমার তাপমাত্রা থাকে নিরক্ষীয় অঞ্চলে -80° সেলসিয়াস এবং মধ্য অক্ষাংশে -60° সেলসিয়াস। 

   iii) বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদানের 75% এই স্তরে রয়েছে। 

   iv) ঝড়, মেঘ, বৃষ্টি, বজ্রপাত সমস্ত প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই স্তরে হয় বলে একে ক্ষুব্ধমন্ডল বলে।

   v) সমস্ত ধূলিকণা বা দূষণজনিত কণা এই স্তরে অবস্থান করে।

  vi) বাতাসের ঘনত্ব এই স্তরে সবচেয়ে বেশি হয়। 

  vii) এই স্তরে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে বাতাসের চাপ কমে। 

 viii) এই স্তরের প্রধান গ্যাস নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন।


       ট্রপোপোজ 

              Tropopause এর অর্থ "where mixing stops" অর্থাৎ যেখানে বায়ুর মিশ্রণ থেমে যায়। ট্রপোস্ফিয়ারের উপরিভাগে অবস্থিত 2 থেকে 3 কিলোমিটার অঞ্চলে বাতাসের তাপমাত্রার কোন পরিবর্তন হয় না একে ট্রপোপজ বলে।

      বৈশিষ্ট্য 

        i) তাপমাত্রা এখানে একই রকম থাকে অর্থাৎ ধ্রুবক থাকে। 

       ii) ট্রপোপজে বাতাসের গড় উষ্ণতা -60° সেলসিয়াস।


খ) স্ট্রাটোস্ফিয়ার (Stratosphere)

       ট্রপোপজের উপরে অবস্থিত স্তরটিতে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। এই স্তরটিতে স্ট্রাটোস্ফিয়ার বলে। স্তরটি ট্রপোপজের উপরিভাগ থেকে 50 কিলোমিটার পর্যন্ত অর্থাৎ 18 থেকে 50 কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।

   বৈশিষ্ট্য 

     i) এই স্তরে বায়ুমণ্ডলীয় কোন গোলযোগ দেখা যায় না বলে এই স্তরকে শান্তমন্ডল বলে।

    ii) উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে বাতাসের উষ্ণতা বাড়তে থাকে। 

    iii)মেঘ, ঝড়বৃষ্টি থাকে না বলে এই স্তরের মধ্য দিয়ে জেট বিমান চলাচল করে।

   iv) এই স্তরের নিচে 15 থেকে 35 কিলোমিটার উচ্চতায় ওজন গ্যাসের প্রাধান্য থাকে। ওজোন গ্যাস তাপ শোষণ করে বলে স্তরটির উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়।

   v) এই স্তরে বায়ুর ঘনত্ব ও চাপ কম থাকে।

   vi) ট্রপোজে বাতাসের উষ্ণতা থাকে - 80⁰ সেলসিয়াস। স্ট্যাটোস্ফিয়ার উপরিভাগে উষ্ণতা থাকে 0⁰ সেলসিয়াস।

  vii) আন্টার্কটিকা অঞ্চলে শীতকালের স্ট্যাটোস্ফিয়ারে জলীয়বাষ্প প্রবেশ করে যে বর্ণময় মেঘের সঞ্চার করে তাকে মৌক্তিক মেঘ বা শুক্তি মেঘ ( Nacreous Cloud or Mother of pearl)  বলে।  


       স্ট্রাটোপজ   

              স্ট্যাটোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বসীমাকে স্ট্র্যাটোপজ বলে। এটি স্ট্রাটোস্ফিয়ার এবং মেসোস্ফিয়ারের মাঝে অবস্থিত।

                 বৈশিষ্ট্য 

                   i) এর গভীরতা 2 থেকে 3 কিলোমিটার।  

                  ii) এই স্থানের উষ্ণতর 0⁰ সেলসিয়াস।

 

গ) মেসোস্ফিয়ার (Mesosphere)

           গ্রিক শব্দ 'মেসো' কথার অর্থ "ভাগ বা মেডেল"।স্ট্র্যাটোপজজে উপরে 80 কিলোমিটার বিস্তৃত স্তরকে মেসোস্ফিয়ার বলে। 

     বৈশিষ্ট্যঃ 

          i) এই স্তরে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে তাপমাত্রা কমতে থাকে। 

         ii)  মেসোস্ফিয়ারের উপরিভাগে তাপমাত্রা থাকে - 90⁰ সেলসিয়াস থেকে -100⁰ সেলসিয়াস।

         iii)  মহাকাশ থেকে আসা উল্কা এই স্তরে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। 

         iv)  এই স্তরে বায়ুর চাপ খুব কম থাকে।  

         v) এই স্তরে সামান্য জলীয় বাষ্প প্রবেশ করে হালকা মেঘের সৃষ্টি হয় একে নৈশদ্যুতি  মেঘ বা নকটিলুসেন্ট ক্লাউড (Noctilucent Cloud)  বলে। 

        মেসোপজ 

           মেসোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বসিমাকে মেসোপজ বলে। 

               বৈশিষ্ট্য 

                   i)   মেসোস্ফিয়ার এবং থার্মোস্ফিয়ারের মাঝে অবস্থিত। 

                   ii)  গভীরতা দুই থেকে তিন কিলোমিটার। 

                  iii)  তাপমাত্রা মাইনাস -100° সেলসিয়াস। 

 

ঘ) থার্মোস্ফিয়ার বা আয়োনোস্ফিয়ার (Thermosphere)

           মেসোপজের পর থেকে 480 কিলোমিটার মতান্তরে 500 কিলোমিটার বিস্তৃত স্তরে তাপমাত্রার দ্রুত বৃদ্ধি পায় এই স্তরকে থার্মোস্ফিয়ার বলে। সূর্য থেকে নির্গত রঞ্জন এবং গামারশ্মি এই স্তরে অবস্থিত আণবিক নাইট্রোজেন এবং পারমাণবিক অক্সিজেনকে ভেঙে আয়নে পরিণত করে। এই কারণে থার্মোস্ফিয়ারকে আয়নোস্ফিয়ার বলে। থার্মোস্ফিয়ারের নিচের দিকে আয়নিত হবার প্রক্রিয়া বেশি দেখা যায়। ফলে থার্মোস্ফিয়ারের নিচের অংশ আয়নোস্ফিয়ার নামে পরিচিত।

      বৈশিষ্ট্য 

          i)  উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। 200 কিলোমিটার উচ্চতায় তাপমাত্রা 700 ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং 480 কিলোমিটার উচ্চতায় তাপমাত্রা 1200° থেকে 1500° সেলসিয়াস হয়।  

          ii)  সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে এই স্তর আয়নিত অবস্থায় থাকে। 

         iii)  ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রেরিত বেতার তরঙ্গ এই স্তরে প্রতিফলিত হয়ে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে।   

         iv)  এই স্তরে মেরুজ্যোতি বা মেরুপ্রভার সৃষ্টি হয়। উত্তর মেরুতে একে সুমেরু প্রভা বা অরোরা বোরিওলিস এবং দক্ষিণ মেরুতে একে কুমেরু প্রভাব বা অরোরা অস্ট্রালিস বলে। 

         v)  বায়ুর ঘনত্ব খুব কম থাকে।


ঙ) এক্সোস্ফিয়ার (Exosphere) 

           থার্মোস্ফিয়ারের উপরে 480 কিলোমিটার বা 500 কিলোমিটার থেকে 750 কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত স্তরটি এক্সোস্ফিয়ার ।

        বৈশিষ্ট্য 

            i)  এই স্তরে অত্যন্ত কম ঘনত্বের হাইড্রোজেন, হিলিয়াম গ্যাস থাকে। 

           ii)  উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে উষ্ণতা সামান্য বৃদ্ধি পায়।


চ) ম্যাগনেটোস্ফিয়ার (Magnetosphere)

           এক্সেস্ফিয়ার স্তরের উপরে 750 কিলোমিটার থেকে 10000 হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত স্তর ম্যাগনেটোস্ফিয়ার।

        বৈশিষ্ট্য 

          i) এই স্তরে স্থায়ী চুম্বকত্বের সৃষ্টি হয়েছে। 

         ii)  ইলেকট্রন ও প্রোটনের প্রাধান্য দেখা যায়।


 








Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url