বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ( Waste Management)
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ( Waste Management)
সমগ্র পৃথিবীতে সম্পদের ব্যবহার অতি দ্রুত হাড়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এই সকল সম্পদের অবশিষ্টাংশ বা অব্যবহৃত অংশ পরিবেশে ফিরে আসছে। বিপুল পরিমাণে এই অবশিষ্টাংশ পরিবেশে ফিরে আসায় বর্জ্যের পরিমাণ পরিবেশে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এবং মানব সমাজের স্বাচ্ছন্দের জন্য এই সকল বর্জ্য পদার্থের ব্যবস্থাপনা একান্ত প্রয়োজন।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাকে বলে? বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপায় কি?
বর্জ্য পদার্থ সৃষ্টির সময় থেকে তার পরিবহন এবং ফেলে দেওয়ার সময় পর্যন্ত বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ হ্রাস, পুনর্ব্যবহার ও পুনর্নবীকরণের মাধ্যমে পরিচালনা করাকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলে।
অন্যভাবে বলা যায় - আমাদের চারপাশে পড়ে থাকা নানা রকম বর্জ্য পদার্থ পেয়ে আমরা যদি আরো ব্যবহার করতে পারি বা সুপরিকল্পিতভাবে তার ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে দিতে পারি সেটাই হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় 3R এবং 4R কী?
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আমরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে করতে পারি।
3R কি?
এর মধ্যে বর্জ্যের পরিমাণ হ্রাস ( Reduce ), পুনর্ব্যবহার ( Reuse ) এবং পুনর্নবীকরণকে ( Recycle ) একত্রে 3R বলে।
4R কি?
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার তিনটি প্রক্রিয়া, যেমন- বর্জ্যের পরিমাণ হ্রাস ( Reduce ), পুনর্ব্যবহার ( Reuse ) এবং পুনর্নবীকরণ ( Recycle ) এর সঙ্গে অপর একটি প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যান ( Refuse ) যুক্ত করে, এই চারটি প্রক্রিয়াকে একত্রে 4R বলে।
নিচেই প্রক্রিয়াগুলি বিস্তৃত আলোচনা করা হলো,-
ক) বর্জ্যের পরিমাণ হ্রাস ( Reduce )
বিভিন্ন সম্পদকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করে আমরা পরিবেশের বর্জ্যের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারি। যেমন,-
১. উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিল্প কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্যের পরিমাণ কমাতে পারি।
২. ব্যবহার কর এবং ফেলে দেওয়ার ( Use and throw ) মত দ্রব্যগুলির পরিবর্তে যে সকল দ্রব্য বারবার ব্যবহার করা যায় সেগুলি ব্যবহার করা প্রয়োজন।
৩. প্যাকেট জাত দ্রব্যের বিকল্পদ্রব্য আমাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারি।
৪. আমরা নিজেদের জীবনযাত্রার মনের পরিবর্তন করে বর্জ্যের পরিমাণ কমাতে পারি।
৫. সম্পদের অপচয় না করে আমরা বর্জ্যের পরিমাণ কমাতে পারি।
পুনর্ব্যবহার ( Reuse )
মানুষের দ্বারা সৃষ্ট এমন অনেক পরিতক্ত পদার্থ বা বর্জ্য পদার্থ আছে যা মানুষ পুনরায় ব্যবহার করতে পারে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য মানুষ বেশি ব্যবহার করলে বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ কমে যায়। যেমন,-
১. বাড়ি থেকে নির্গত তরকারি বা ফলের খোসা গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায় অথবা তা থেকে জৈব সার তৈরি করে বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ কমানো যায়।
২. আমাদের বাড়িতে সেই সকল বাসনপত্র ব্যবহার করা প্রয়োজন যেগুলি ব্যবহারের অনুপোযোগী হলেও সেগুলি থেকে নতুন বাসনপত্র তৈরি করা যায়। যেমন- অ্যালুমিনিয়াম, তামা প্রভৃতি দ্বারা নির্মিত বাসন।
৩. যে সকল দ্রব্য সারাই করে ঠিক করা যায় সেগুলি বর্জ্য পদার্থ হিসেবে ফেলে না দেওয়াই ভালো.
৪. খবরের কাগজ ফেলে না দিয়ে সেগুলি দিয়ে ঠোঙা তৈরি করলে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের মোরক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
৫. বিভিন্ন ইলেকট্রনিক দ্রব্য খারাপ হয়ে গেলে সরাসরি ফেলে না দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে দিলে, সেগুলো পুনরায় ব্যবহার উপযোগী তৈরি করা যায়।
৬. পুরনো বই বা কাপড় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে দিলে তরাই গুলি পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করতে পারে।
পুনর্নবীকরণ ( Recycle )
আমাদের ব্যবহৃত এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলির ভাঙ্গা অংশ থেকে পুনরায় নতুন দ্রব্য তৈরি করা যায়। যেমন -
১. প্লাস্টিক, কাচ প্রভৃতি থেকে পুনরায় প্লাস্টিক বা কাচ নির্মিত দ্রব্য তৈরি করা হয়।
২. উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে লোহার টুকরো বা স্ক্রাব লোহা থেকে ইস্পাত তৈরি করা হয়।
৩. ছেঁড়া কাপড়, পুরনো কাগজ প্রভৃতি থেকে পুনরায় নতুন কাগজ তৈরি করা হয়।
৪. সবজি বা ফলের খোসা থেকে উন্নতমানের জৈব সার নির্মাণ করা হয়।
৫. পুরনো তামা, অ্যালুমিনিয়াম ও টিন থেকে প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন দ্রব্য নির্মাণ করা হয়।
প্রত্যাখ্যান ( Refuse )
পরিবেশকে সুস্থ রাখতে আমাদের কিছু জিনিসের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। যেমন -
১. প্লাস্টিক নির্মিত দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধ করা প্রয়োজন।
কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি :
আমরা যে কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় বর্জ্য ব্যবহার করি তা সুপরিকল্পনার মাধ্যমে বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে দিতে পারে। নিচে কিভাবে কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা করতে পারি তা আলোচনা করা হল,-
1. কঠিন বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা:-
কঠিন বর্জ্যদ্রব্যের ব্যবস্থাপনার কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। যেমন -
ক. বর্জ্য পৃথকীকরণ :
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল এই পদ্ধতি। কঠিন বর্জ্যের মধ্যে দু-ধরনের বর্জ্য থাকে। একধরনের বর্জ্য আছে যেগুলি প্রকৃতিতে সহজেই আপনাআপনি পচে যায় ও মাটিতে মিশে যায়। এদের বলা হয় জৈব ভঙ্গুর বর্জ্য। যেমন- শাকসবজি ও খাদ্যদ্রব্যের অবশিষ্টাংশ, ডাবের খোলা, কাগজ, কাপড়, তুলো, গোবর, লতাপাতা, ফুল, ফল, মাছ, মাংস ইত্যাদি এর উদাহরণ।
আর-একধরনের বর্জ্য আছে যেগুলি একদম পচনশীল নয়। এরা দীর্ঘদিন মাটিতে থাকার পরেও কোনোরকম পরিবর্তন হয় না বা বিশ্লিষ্ট হয় না, এদের জৈব অভঙ্গুর বর্জ্য বলে। যেমন- পলিমার, পলিথিন, টায়ার, টিউব, কাচ, ধাতব বর্জ্য, রাসায়নিক বর্জ্য ইত্যাদি এর উদাহরণ।
বর্জ্য পদার্থকে এভাবে আলাদা করে তাদের পৃথক পৃথকভাবে বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য গড়ে তুলতে পারলে বর্জ্যের পরিমাণ যেমন হ্রাস পাবে, তেমন সম্পদের পুনরুদ্ধারও সম্ভব হবে।
খ. ল্যান্ডফিল বা ভরাটকরণ(Landfill) :
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো ভরাটকরণ। বর্জ্য দিয়ে জমি ভরাট করার কাজটিকে স্থাস্থ্যসম্মত জমি ভরাটকরণ বা স্যানিটারি ল্যান্ডফিল বলা হয়।
পদ্ধতি:
এটি একটি বর্জ্য পদার্থ অপসারণ ও নষ্ট করার সহজ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে আবর্জনার জৈব অংশগুলিকে আলাদা করে মাটির সঙ্গে স্তরে স্তরে সাজানো হয়। এই পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট স্থানে আবর্জনার জৈব অংশ আলাদা করে একটি 2 মিটার উঁচু স্তর বিছিয়ে দেওয়া হয়। তার ওপরে 20-25 সেমি মাটির স্তর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মাটির মধ্যেকার জীবাণু আবর্জনার ভৌত ও রাসায়নিক পদার্থের পরিবর্তন ঘটায়। এর ফলে নানা ধরনের গ্যাস সৃষ্টি হয় যা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
সুবিধা:-
i) এর ফলে আবর্জনা বা বর্জ্য বিনষ্ট করা সম্ভব হয়।
ii) চাপা দেওয়া আবর্জনা জৈব সারে পরিণত হয়।
iii) বর্জ্যের বিয়োজনের ফলে মিথেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি গ্যাস উৎপন্ন হয়। এই গ্যাসগুলিকে ল্যান্ডফিল গ্যাস বলে। এই গ্যাসকে তাপ উৎপাদন বা গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হয়।
অসুবিধা:-
i) নোংরা দূষিত জল ভূগর্ভস্থ জলস্তরে মিশে যায় যা পানীয় জলের ক্ষতি করে।
ii) বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে বৃষ্টির জলের সঙ্গে দূষিত বর্জ্য পদার্থ ধুয়ে স্থানীয় জলাশয়ে মিশে গিয়ে জলজ জীবের ক্ষতি করে।
iii) মিথেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি গ্যাস বায়ুতে মিশলে জীবের ক্ষতি করে।
2 পচনশীল কঠিন ও তরল বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা :
ক. কম্পোস্টিং (Composting) :
যে পদ্ধতিতে জৈব বর্জ্যগুলিকে আলাদা করে তাকে যন্ত্রের সাহায্যে চূর্ণবিচূর্ণ করে ওই জৈব পদার্থ ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা বা জীবাণুর দ্বারা পচন ঘটিয়ে হিউমাস জাতীয় পদার্থে পরিণত করা হয় তাকে কম্পোস্টিং বলে। এর ফলে সৃষ্ট এই হিউমাস জাতীয় পদার্থকে কম্পোস্ট (compost) বলে ।
প্রকারভেদ:
কম্পোস্টিং মূলত দুই প্রকার। যথা,-
i) সবাত কম্পোস্টিং (aerobic composting):
বায়ুর উপস্থিতিতে জৈব পদার্থকে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর দ্বারা বিশ্লেষণ ঘটানোর প্রক্রিয়াকে সবাত কম্পোস্টিং বলে।
ii) অবাত কম্পোস্টিং (anuerobic composting):
বায়ুর অনুপস্থিতিতে জৈব পদার্থকে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর দ্বারা বিশ্লেষণ ঘটানোর প্রক্রিয়াকে অবাত কম্পোস্টিং বলে।
সুবিধা:-
i) কম্পোস্ট সার মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।
ii) কম্পোস্টের মধ্যে কপার, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম ইত্যাদি অণুখাদ্য থাকায় উদ্ভিদের পক্ষে অপরিহার্য।
iii) কম্পোস্ট মৃত্তিকার গঠনকে উন্নত করে।
3. তরল বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা :
ক. নিষ্কাশন/নিকাশি (Drainage) :
তরল জাতীয় বর্জ্য পদার্থ ব্যবস্থাপনায় এই নিষ্কাশন পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়। পৌর প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি, হোটেল, হাসপাতাল, শিল্পকলকারখানা প্রভৃতি মানুষের বাসস্থান ও কর্মস্থান থেকে যে জল নর্দমার মধ্যে এসে পড়ে, তার মধ্যে জৈব বর্জ্য পদার্থ, প্লাস্টিকের দ্রব্য, ময়লা, ধাতুর টুকরো, দূষিত বর্জ্য পদার্থ, সংক্রামক রোগজীবাণু, ধুলো-বালি-কাদা প্রভৃতি মিশে থাকে। নর্দমার এই জল সরাসরি নদী, পুকুর, হ্রদ কিংবা সমুদ্রে মিশে জলকে দূষিত করে।
বর্জ্য পদার্থ নর্দমায় পড়ার আগে গৃহীত ব্যবস্থাপনা:
১. গৃহস্থালির অপরিষ্কার জল নির্গমনের জন্য পয়ঃপ্রণালী বা নিকাশি ব্যবস্থা অতি উন্নতমানের হওয়া প্রয়োজন।
২. জলদূষণের বিভিন্ন উৎস সন্ধান করে তার প্রতিকার করা দরকার।
৩. শিল্পকারখানায় বাধ্যতামূলক ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (জল ছাঁকা ও পরিষ্কার করার যন্ত্র) বসিয়ে জলকে পরিশুদ্ধ করে ছাড়তে হবে।
শহরাঞ্চলের নর্দমার জলকে শোধন করার পদ্ধতি:
(i) প্রাথমিক পরিশোধন পদ্ধতি :
প্রথমে বড়ো বড়ো জলাধার তৈরি করে সেখানে ওই নোংরা জল জমা করা হয়। এখানে ভারী ওজনের বর্জ্যগুলি থিতিয়ে যায়। পরে এগুলিকে আলাদা করা হয়।
(ii) গৌণ পরিশোধন পদ্ধতি :
দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ওই জলের ভাসমান ও দ্রবীভূত জৈব পদার্থগুলিকে সরিয়ে ফেলা হয়।
(iii) প্রগৌণ পরিশোধন পদ্ধতি :
এই স্তরে জলের রাসায়নিক ও বিষাক্ত দ্রব্যগুলিকে সরিয়ে জলকে বিপন্মুক্ত করে নদী বা খালে ফেলা হয়।
4. গ্যাসীয় বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা :
ক. স্ক্র্যাবার [Scrubber] :
বায়ুর মধ্যে ভাসমান দূষিত বস্তুকণা পরিশ্রুত করার যন্ত্রের নাম স্ক্রাবার। এই যন্ত্রের সাহায্যে বায়ুকে পরিশ্রুত করার পদ্ধতিকে বলা হয় স্ক্রাবিং।
পদ্ধতি:
বস্তুকণা মিশ্রিত বায়ু বা গ্যাসকে জলে-ধোওয়ার যন্ত্রের মধ্য দিয়ে চালনা করা হয়, ফলে বস্তুকণা জলে মিশে ভারী হয়ে পাত্রের নীচে থিতিয়ে পড়ে এবং পরিষ্কার বাতাস বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়।
স্ক্রাবারের প্রকার: স্ক্রাবার মূলত দুই প্রকার।-
(i) শুষ্ক স্ক্রাবার (Dry Scrubbers):
এটি ব্যবহার করা হয় নির্গত ধোঁয়া থেকে অম্ল দূর করার জন্য।
(ii) আর্দ্র স্ক্রাবার (Wet scrubber):
এটি ব্যবহার করা হয় দূষণকারী গ্যাস, দূষণ কণা প্রভৃতি দূর করার জন্য।